
নিন্দা থেকে নক্ষত্রে: ইতিহাসের পাতা উল্টে ফিরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
নিজস্ব প্রতিবেদক, ১৯ আগস্ট ২০২৫ —
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় দিন। সেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে একটি সামরিক-রাজনৈতিক চক্র। উদ্দেশ্য ছিল একটাই—তাঁকে শুধু শারীরিকভাবে নয়, ইতিহাস থেকেও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতা। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম, সরকারি নথিপত্র ও প্রচারে তাঁকে অস্বীকার করা হয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর অবদানকে ভুলভাবে তুলে ধরতে চালানো হয় দীর্ঘমেয়াদি অপপ্রচার ও রাজনৈতিক মিথ্যাচার। তৈরি করা হয় এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে তাঁর নাম উচ্চারণ করাও হয়ে দাঁড়ায় সাহসের বিষয়।
❝ কিন্তু ইতিহাস থেমে থাকেনি ❞
সময়ই ক্রমশ উন্মোচন করেছে ইতিহাসের সত্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের যে সংগ্রাম—তা আর চাপা থাকেনি। একসময় যে ভাষণ চেপে রাখা হয়েছিল, সেই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আজ ইউনেস্কোর স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য।
কিন্তু আজ ফের সেই ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টার অভিযোগ
বর্তমানে ড. ইউনুস-সমর্থিত সরকার (২০২৪) ক্ষমতায় আসার পর আবারও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এক প্রকার ‘নতুন ইতিহাস নির্মাণ’ চলছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি।
বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ছবি ও মুরাল সরিয়ে ফেলা, প্রতিষ্ঠানে তাঁর নামাঙ্কিত অংশ পরিবর্তন, এমনকি সরকারি অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে চলছে তীব্র প্রতিক্রিয়া।
❝ ** বঙ্গবন্ধুর মুরাল ভাঙার অভিযোগ উঠেছে।**❞
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্যমতে, “পুরাতন রাজনীতিকে বিদায়”–এই স্লোগানকে সামনে রেখে ইউনুস সরকার “নতুন ইতিহাস লেখার নামে” পুরনো ইতিহাস মুছে ফেলার পথেই হাঁটছে।
এছাড়া, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত অধ্যায়গুলো সীমিত করে ফেলার খসড়া নিয়েও চলছে বিতর্ক।
“ইতিহাস আবারও ফিরে আসবে”—বিশ্বাস বিশ্লেষকদের”
এমন পরিস্থিতিতে ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন—এটা নতুন কিছু নয়। এর আগে সামরিক শাসনামলেও ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা হয়েছে।
“সময় আবারও প্রমাণ করবে—কাকে ইতিহাস গ্রহণ করে, আর কাকে ছুঁড়ে ফেলে,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক অধ্যাপক।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন,
“যারা ইতিহাস বিকৃত করতে চায়, তারা জনগণকেই অপমান করছে। বঙ্গবন্ধুর নাম শুধু ইতিহাসে নয়, মানুষের হৃদয়ে লেখা।”
অন্যদিকে বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন,
“কোনো ছবিই সরানো হয়নি, যা হয়েছে তা শুধুই ‘সংস্কার’ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের অংশ।”
তবে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও প্রতিবেদনগুলো বলছে ভিন্ন
ইতিহাসের রায় কি এবারও একই হবে?
বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস কোনো একক রাজনৈতিক দলের নয়—এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, আত্মত্যাগ, ও আত্মপরিচয়ের ইতিহাস।
যে ইতিহাস একবার মুছে ফেলার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এবারও কি সফল হবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিন্দা, অপবাদ ও মিথ্যাচার সাময়িক জয় পেতে পারে, কিন্তু সময়ের আদালতে সত্যই শেষ কথা বলে।
আর সেই সত্যই বঙ্গবন্ধুকে এনে দিয়েছে “জাতির পিতা”-র স্বীকৃতি।
আবার ফিরে এসেছে বঙ্গবন্ধুর নাম
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তার প্রতীক। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিসরে, তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয় “জাতির পিতা” হিসেবে। তাঁর জীবন ও আদর্শ আজ তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন,
ইতিহাসবিদদের মতে, “বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে চালানো অপপ্রচার একপ্রকার ‘ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ড’। কিন্তু সত্য কখনো দীর্ঘদিন চাপা থাকে না। জনগণই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় কে নায়ক, কে খলনায়ক।”
তাঁরা আরও বলেন, “বিশ্ব ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ আছে—যেখানে কোনো নেতা তাঁর সময়ের শাসকের হাতে নিন্দিত হয়েছেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ তাঁকে দিয়েছে নায়কত্বের শ্রেষ্ঠ মুকুট। বঙ্গবন্ধু তেমনই এক অনন্য দৃষ্টান্ত।”
ইতিহাসের রায়,
আজ স্পষ্ট—বাংলাদেশের ইতিহাস বঙ্গবন্ধু ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। তাঁর অনুপস্থিতি ইতিহাসের এক কুয়াশাচ্ছন্ন অধ্যায়, আর তাঁর প্রত্যাবর্তন ইতিহাসের দীপ্তিময় সত্য। নিন্দা তাঁকে মুছে ফেলতে পারেনি, বরং তাঁকে আরও উজ্জ্বল করেছে।
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…”—শুরু হয়েছিল ভাষা দিয়ে, শেষ হয়েছিল আত্মত্যাগে। সেই পথেরনামই বঙ্গবন্ধু।
ইতিহাসের শিক্ষা,
“যারা একসময়ে দানব হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন, সময়ের প্রবাহে তাঁরাই হয়ে ওঠেন নক্ষত্র।”
নিন্দা, অপবাদ, কিংবা রাজনৈতিক অপপ্রচার—তা সাময়িকভাবে একজন নেতাকে কলঙ্কিত করতে পারে; কিন্তু যদি তাঁর আদর্শে থাকে জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, যদি তাঁর কর্মে থাকে ত্যাগ ও সত্যের ভিত্তি—তাহলে সময়ই তাঁকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠত্বে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়।
আজকের সমাজে যখন সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা হয়, ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা হয়—তখন এই উদাহরণগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
নেতা নয়, সত্যই চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়।
আর সেই সত্যই তৈরি করে নিন্দা থেকে নক্ষত্র হয়ে ওঠার পথ।
কিন্তু সময় বদলায়। জনগণের দাবিতে ফিরে আসে সত্য। বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি ফিরে আসে জাতীয় পর্যায়ে। ৭ই মার্চের ভাষণইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায়। তাঁকে “জাতির পিতা” হিসেবে সম্মানিত করে গড়ে ওঠে নতুন প্রজন্মের চেতনা।